বালিয়াটি জমিদার বাড়ি এলবাম । ব্যাচ ২৭ । আশাইউবি । ১০-ই মার্চ ২০১৭
দেখতে দেখে পার করে এলাম অনার্স এর একটি বছর। এই কটা দিনেই গড়ে উঠেছে নতুন বন্ধুত্ব, নতুন বন্ধন। নিজেদের মাঝে তো বটেই সম্মানিত শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে গড়ে উঠেছে এক মায়ার বন্ধন। সেই বন্ধন কে আরো দৃঢ় করতে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই ঐতিহাসিক বালিহাটি জমিদার বাড়ি ভ্রমন এর। নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে ১০ই মার্চ ২০১৭ তে আমরা আমাদের পিকনিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি। আমরা আশা টাউয়ার এর সামনে থেকে সকাল নয়টা পনেরতে যাত্রা শুরু করি।
সবাই সবার জায়গা থেকে সহযোগীতা করেছে বলেই সফলভাবে পিকনিক সম্পন্ন হয়েছে তাছাড়া কিছু মানুষের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এমন মোনরম পরিবেশে একদিন কাটাতে পেরেছি। রিয়াদ,ফাহাদ,সামিউল অসাধারন ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের কে ধন্যবাদ না জানালেই নয়।
সম্মানিত শিক্ষক যাদের শিক্ষায় আমরা নিজেকে আলোকিত করতে চাই তারা আমাদের যে কত ভালবাসেন তার প্রমান পাউয়া যায় এই পিকনিক থেকেই। তারা আমাদের তাদের মূল্যবান সময় থেকে একটি দিন দিয়েছেন। আমরা তাদের সময়ের যথাযত মূল্যায়ন করতে পারি না বা আমাদের আপ্যায়নেও যথেষ্ট ত্রুটি ছিল তবুও তাঁরা সব মেনে নিয়ে আমাদের যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন তা আসলেই অতুলনীয়।
সবকিছুর পরেও বালিহাটি জমিদার বাড়িতে কাটানো দিনটি কেটেছে অসাধারন ভাবেই। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই মনে হচ্ছিল সেই ১৯ শতকে প্রবেশ করলাম যখন জমিদার গোবিন্দ রাম সাহা বালিহাটি জমিদার পরিবারের গোড়াপত্তন করেন। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লবণের বণিক ছিলেন। জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকারের মধ্যে “কিশোরিলাল রায় চৌধুরী, রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী তৎকালীন শিক্ষাখাতে উন্নয়নের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিশোরিলাল রায় চৌধুরীর পিতা এবং যার নামানুসারে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়।
যখন জমিদার বাড়ির প্রাজ্ঞন দিয়ে হাঁটছিলাম তখন রেনেসা যুগে নির্মিত স্থাপত্যকৌশলের সাহায্যে নির্মিত এই প্রাসাদের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করছিল। এই বিশাল প্রাসাদটি ২০ একরের চেয়ে বেশি স্থান জুড়ে অবস্থিত। আসলে এই প্রাসাদটি একই রকম দেখতে কিন্তু পাচটি স্বতন্ত্র ব্লকের সমন্বয়ে গঠিত যার সর্ব পূর্বদিকের একটি ব্লক ব্যতিত বাকি চারটি ব্লক এখনো বিদ্যমান। বর্তমানে চারটি ব্লক আছে যার মধ্যে মাঝের দুইটি ব্লক, যার একটি দ্বীতল বিশিষ্ট এবং আরেকটি টানা বারান্দা বিশিষ্ট যা তিনতল বিশিষ্ট।
চারটা বিল্ডিং, প্রায় ৫০ ফিট উঁচু এক একটা প্রাসাদ এতই কারুকার্জে পুর্ণ যে প্রতি মুহুর্তেই বিস্মিত হচ্ছি। আট ইঞ্চি করে সিঁড়ির উত্থান আর বিশাল বিশাল স্তম্ভগুলো চুন-সুরকি আর ইট দিয়ে কিভাবে কত পরিশ্রমের মাধ্যমে যে নির্মিত হয়েছিলো আমি হতবাক। প্রতিটা স্তম্ভের পেডেস্টাল ছয় ফিটের উপর। আর স্তম্ভ থেকে স্তম্ভের দুরত্বও আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের দৈহিক মাপ সমর্থন করছে। গ্রীক স্থাপত্যের মতই কারুকার্জমন্ডিত স্তম্ভের উপরের দিকটা (ক্যাপিটাল)।
আজ আমাদের দেশের রুয়েট বুয়েটের স্থাপত্যের ছাত্রদের আমাদের পাশের দেশগুলোতে কি হয়েছে, কি হচ্ছে এসব যতটুকু জোর দিয়ে পড়ানো হয়, জানানো হয়, সে হিসেবে অন্তত দেশের পুরোনো স্থাপত্যের নামগুলোও আমাদের সাথে পরিচিত করা হয় না।
১নং প্রাসাদের মাঝের স্তম্ভের পিছনে থাকা গোলাকার লৌহ নির্মিত সিঁড়ি আর দেয়ালের উপরের নিঁখুত কাজগুলো যতই প্রাসাদের ভেতরে টানুক, তালাবন্ধ থাকার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারলাম না।
এই প্রাসাদের চারটি ব্লকের পিছন অংশে চারটি আলাদা আভ্যন্তরিণ ভবন বা অন্দর্মহল আছে। উত্তরদিকে কিছুদূরে অবস্থিত পরিত্যক্ত ভবনটি হল বহির্মহল যা কাঠের কারুকার্য সম্পন্ন। এই ভবনে প্রাসাদের চাকর বাকর, গাড়ি রাখার গ্যারেজ, ঘোড়াশাল ছিল বলে ধারনা করা হয়। এই বিশাল প্রাসাদটির চারপাশ সুউচ্চ দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই প্রাসাদের তিনটি প্রবেশপথ আছে। যার প্রত্যেকটিতে অর্ধবৃত্তাকার খিলান আকৃতির সিংহ খোদাই করা তৌরণ বিদ্যমান।
চলে এলাম সাঁন বাধানো পুকুর পাড়ে। পুকুরের অপরপাশের সারিবদ্ধ দরোজা গুলো দেখে আমরা ধারণা করতে লাগলাম কি হতে পারে ঐগুলো। হয়তোবা প্রক্ষালন কক্ষ কিংবা পোশাক পরিবর্তন কক্ষ। কাছে গিয়ে দেখি সারিবদ্ধ কক্ষ গুলো সব প্রক্ষালন কক্ষ । আর গুটিকয়েক পোশাক পরিবর্তন কক্ষ। অদ্ভুত হলেও যেখানে আমরা আধুনিক সমাজে প্রতিটা কক্ষের সাথে একটা করে পয়নিষ্কাশন কক্ষ দেখি, সেখানে এই প্রাসাদগুলোতে পয়নিষ্কাশন কক্ষ একদম পিছনে। আর বলতে গেলে আলাদাই। পুকুরের সিঁড়িও পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা। পুর্ব পার্শ্বের একটি সিঁড়ি এখন আর নেই। তারমানে পুকুরে নামার জন্য সাতটা সিঁড়ি ছিলো। সবমিলিয়ে ৩ টা কুয়ো চোখে পড়লো। সবগুলোই ভরাট হয়ে গেছে।
এরপর কিছু টা এগিয়ে এলাম।
পানি নিষ্কাসন এর সাহায্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন এর যে ব্যাবস্থা দেখলাম তা আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি প্রথমে একে সাধারন পানি নিষ্কাসন এর টানেল মনে করলেও বন্ধু সামিউল এর বর্ননাতে আমার ভুল ভাঙ্গে। সেই আমাকে জানায় যে এটি শুধু পানি নিষ্কাসন এর জন্য নয় এটি অন্দর মহলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। যা বর্তমান কালের এসির মত কাজ করে।
অন্দর মহলের বাইরের কারুকাজ দেখে ৪ নম্বর প্রাসাদের সামনে এলাম। বালিয়াটিতে ১৯২৩ সালের দিকে জমিদার কিশোরী রায় চৌধুরী নিজ ব্যয়ে একটি এলোপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। বর্তমানে এটি সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। জমিদার হীরালাল রায় চৌধুরী সাটুরিয়া থেকে বালিয়াটির প্রবেশ পথের পাশে কাউন্নারা গ্রামে একটি বাগানবাড়ী নির্মাণ করেন এবং সেখানে দীঘির মাঝখানে একটি প্রমোদ ভবন গড়ে তোলেন যেখানে সুন্দরী নর্তকী বা প্রমোদ বালাদের নাচগান ও পান চলত। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দৃষ্টিনন্দন ও প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
ঘুরতে ঘুরতে পাঁচটা বেজে গেল। আমরা আমাদের ভ্রমনের বিরতি টেনে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
No comments