ইয়াবার ইতিহাস-সেবনের পরিনাম।

শুরুটা ১৯১৯ সালে। জাপানিরা ওষুধ হিসেবে ইয়াবা তৈরির পরিকল্পনা করে। মূলত জীবন বাঁচানোর জন্যই তাদের এই আবিষ্কার। এর পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মান প্রেসিডেন্ট এডলফ হিটলার তার মেডিকেল চিফকে আদেশ দিলেন দীর্ঘ সময় ব্যাপী যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাদের যাতে ক্লান্তি না আসে এবং উদ্দীপনায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে বা বিমানের পাইলটের নিদ্রাহীনতা, মনকে উৎফুল্ল, চাঙ্গা

মিয়ানমারে ওয়া এবং কোকাং নামের আদিবাসী সম্প্রদায় ইয়াবা এর সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশের যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেশ মাতৃকার স্বার্থে অনেক সেনা প্রধান ইয়াবা ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়াবার প্রভাব এত দূত ছড়িয়ে পড়বে ভাবতে পারেনি কেউ। বাংলাদেশের টেকনাফ বর্ডার দিয়ে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম প্রবেশ করে ১৯৯৭ সালে। কিন্তু এর আগে ইয়াবার নানা উপাদানকে প্রাণ রক্ষা কারী ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন ডাক্তার। ২০০১ এ বাংলাদেশের অভিজাত এলাকাগুলোতে ইয়াবা তরুণ-তরুণীদের মানিব্যাগে স্থান করে নেয়। এখন এ নেশা-দ্রব্য ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর অলিগলির মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মাঝেও। নেশা গ্রহণকারীদের তালিকায় স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে, ব্যবসায়ী, গ্লামার-জগতের বাসিন্দা থেকে শুরু করে গৃহবধূ পর্যন্ত।

শুধুই ক্ষতি-
ইয়াবায় উত্তেজক এম সিটা-মিন এবং ক্যাফেইন রয়েছে৷ ইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা, অনিদ্রা, খিটখিটে ভাব ও আগ্রাসী প্রবণতা বা মারামারি করার ইচ্ছা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ও বমি ভাব, ঘাম, কান-মুখ লাল হয়ে যাওয়া এবং শারীরিক সঙ্গের ইচ্ছা বেড়ে যায়। তবে এ সবই অল্প কয়েক দিনের বিষয়। বাড়ে হৃৎস্পন্দনের গতি, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শরীরের তাপমাত্রা। মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোর ক্ষতি হতে থাকে এবং কারও কারও এগুলো ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকে ইয়াবা সেবীর হাত-পা কাঁপে, হ্যালুসিনেশন হয়, পাগলামি ভাব দেখা দেয়, প্যারানয়া হয়। কারও কারও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, খিঁচুনি হয়। খিটখিটে ভাব, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুর, নার্ভাসনেসে ভুগতে থাকে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিরা। স্মরণশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও কারও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। লেখাপড়ায় খারাপ হয়ে একসময় ডিপ্রেশন বা হতাশা-জনিত নানা রকম অপরাধ প্রবণতা, এমনকি আত্মহত্যাও করে থাকে। হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে অনেকে মারা যায়। অনেকে মরে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে। কেউ কেউ টানা সাত থেকে ১০ দিন জেগে থাকে, তারপর ড্রাগ ওভার ডোজেও মরে যায়।
তারুণ্যের শতকরা ২৫ ভাগই ইয়াবা আসক্ত-
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই মুহূর্তে দেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্র-গুলোয় প্রায় ১২,৩০৪ জন মাদকাসক্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন৷ তাদের বড় একটি অংশ হলো ইয়াবা ট্যাবলেটে আসক্ত৷ পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে দিন দিন ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে৷ ইয়াবা একধরনের সিনথেটিক এমফেটামাইন ড্রাগস। বাংলাদেশে মাদকাসক্তের শতকরা ২৫ ভাগ এখন ইয়াবা ট্যাবলেটে আসক্ত৷ পরিবহন এবং সেবন সহজ হওয়ায় দ্রুত এর থাবা বিস্তৃত হচ্ছে৷ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট৷ ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে এখন মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখ৷ এই মাদকাসক্তের বড় অংশ গাঁজা, হেরোইন এবং ফেনসিডিল-এ আসক্ত হলেও পরিস্থিতির নতুন মাত্রা আতঙ্কের৷ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সারা দেশ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করেছে৷ এর বাইরে ব়্যাব, পুলিশ এবং সীমান্ত এলাকায় বিজিবি এর আরো তিনগুণ ইয়াবা আটক করেছে৷ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত টানা দু’দিনের অভিযান চালিয়ে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার এবং চোরাচালান ও অবৈধ ব্যবসা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এক নারীসহ ছয় জনকে রাজধানী থেকে আটক করেছে৷
এই ইয়াবা মূলত মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার এবং টেকনাফ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷ এসব পরিবহনের জন্য নারী ছাড়াও নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়৷ আরো জানা গেছে, ঢাকায় ইয়াবা মাদকের অন্তত ২০টি চক্র সক্রিয় আছে৷ এইসব চক্রের সঙ্গে নানা পেশা ও শ্রেণির লোক জড়িত৷ এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের জড়িত থাকার তথ্যও রয়েছে তাদের কাছে৷ গোয়েন্দা তথ্যানুসারে, একটি সেলফোনের কভারের মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ পিস ইয়াবা পরিবহন করা যায়৷ ট্যাবলেট হওয়ায় সহজে কেউ সন্দেহও করে না৷ ইয়াবা বিভিন্ন রং এবং ফ্লেভারে পাওয়া যায়৷ এর বিক্রি এবং সেবন উভয়ই সহজ৷ ফলে মাদকাসক্ত তরুণরা এখন ইয়াবার দিকেই ঝুঁকছে৷ পাইকারি এক পিস ইয়াবার দাম ১২০ টাকা হলেও, খুচরা ২৪০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ তাই এখনই জন-সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন৷ পাশাপাশি দরকার এর চোরাচালানের বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া৷

তবে ইয়াবা সম্পর্কে ভয়াল তথ্যগুলো আমরা কেউই জানি না। আর জানি না বলেই অনেকের চোখেই এই মাদক ভয়ংকর কিছু নয়। কী হয় ইয়াবা সেবন করলে? আসুন, জানি সেই ভয়াল তথ্যগুলো।

ইয়াবা সেবনকারীরা ৭ টি পর্যায় অতিক্রম করে। ১। ঝোঁক ২। উচ্চ পর্যায় ৩। অনিয়ন্ত্রিত গ্রহন ৪। নিয়ন্ত্রন হারানো ৫। ভেঙে পড়া ৬। অপ্রীতিকর পরিণাম ৭। মুক্তি...

১। ঝোঁকঃ
ধোঁয়া বা ইনজেকশন যেভাবেই নেয়া হোক না বেশ সুক্ষ একটা সুখানুভূতি শুরু হয় ইয়াবা সেবনকারীর বুকের মধ্যে। যারা সেবন করেছেন, তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলেছেন, অতিরিক্ত কথা বলার একটা বাতিক দেখা যায় সেবন করার পর। বৃদ্ধি পায় হার্ট বিট, মেটাবোলিজম, ব্লাড প্রেসার। এই ধরনের অনুভূতি থাকে ৫ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট।
২। উচ্চ পর্যায়
ঝোঁক পর্যায়ের পর আসে এই পর্যায়। এই পর্যায়ে ইয়াবা সেবনকারীরা নিজেদের মনে করতে থাকে স্মার্ট, যুক্তিবাদী। ফলে, কেউ কথা বললে, তাঁকে শেষ করতে না দিয়েই বারেবারে নিজের অজান্তে মানুষের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে ইয়াবা সেবনকারীরা। এই পর্যায়ে ডিলুশন ইফেক্ট দেখা যায়। ইয়াবা সেবনকারীরা এই পর্যায়ে অগুরুত্বপূর্ণ কাজ খুব মনোযোগের সাথে করতে থাকে। হয়তো, দেখা যাচ্ছে কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের জানালা পরিস্কার করছে। এই পর্যায় ৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
৩। অনিয়ন্ত্রিত গ্রহণ
হাই পর্যায়ে বেশিক্ষন থাকার জন্য সেবনকারীরা অতিরিক্ত গ্রহণ করতে থাকে ইয়াবা। এই পর্যায়ে সেবনকারী হয়ে উঠে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে হাইপার একটিভ। এই ক্ষেত্রে ঝোঁক এবং উচ্চ পর্যায় ছোট হতে থাকে, এক সময় নাই হয়ে যায়।
৪। নিয়ন্ত্রন হারানো
ইয়াবা সেবনকারী এই পর্যায়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। যতই ইয়াবা নেয়া হোক না কেন, সেবনকারী কিছুতেই আর প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে পারে না। সৃষ্টি হয় ভয়ানক শূন্যতা। যেতে হয় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।
চামড়ার নিচে আমাদের কখনোই পোকা হেঁটে যায় না, কিন্তু এই পর্যায়ে অবিশ্বাস্য রকমের চুলকানি শুরু হয়, তাই আপনার ঠিকই মনে হবে চামড়ার নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পোকা। কয়েকদিন ধরে আসবে না আর কোন ঘুম।
৫। ভেঙ্গে পড়া
ধকল শরীর আর কুলাতে পারে না। এই পর্যায়ে এসে সেবনকারীর ঘুম পায়। ৩ দিন স্থায়ী থাকে এই পর্যায়।
৬। অপ্রীতিকর পরিণাম
এই পর্যায়ে সেবনকারী শারীরিক, মানসিক এবং ইমশনালি ভেঙে পড়ে। আরও বেশী ইয়াবা গ্রহন করার জন্য সেবনকারী অস্থির হয়ে পড়ে।
৭। মুক্তি
যদি কেউ ইয়াবা ছেড়ে দিতে চায় তবে ৩০ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে এটা বুঝতে যে সে ছেড়ে দিতে যাচ্ছে। তাই এটা খুবই কঠিন ছাড়ানো। ৯৩% ক্ষেত্রে মুক্তি মেলে না!

Jane's Intelligence Review অনুযায়ী মায়ানমার বেশ কম দামে, প্রমোশনাল রেটে ইয়াবা সরবরাহ করছে বাংলাদেশে। বার্মা বৃহৎ ইয়াবা উৎপাদনকারী দেশ। বিচ্ছিন্নতা বাদী সংগঠন ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি-এর মূল অর্থের যোগান আসে এই ইয়াবা বিক্রির মাধ্যমে।
রাখার জন্য একটা কিছু আবিষ্কার করতে। টানা ৫ মাস রসায়নবিদগণ চেষ্টা চালিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন ও ক্যাফেইনের সংমিশ্রণে তৈরি করলেন ইয়াবা। ব্যাস! হিটলারের উদ্দেশ্য সফল। সেনারা মানসিক শক্তিতে বলিয়ান হল।

সমকালের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে ইয়াবার চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। আর এই ব্যাপক চাহিদা মেটাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থাপিত হয়েছে ৩৭টি কারখানা। এসব কারখানায় মিয়ানমারভিত্তিক ১০ ডিলার ওই সব কারখানায় তৈরি করা প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখের বেশি ইয়াবা পৌঁছে দেয় টেকনাফের ডিলারদের কাছে। ইয়াবার ব্যাপক চাহিদা মেটাতে মিয়ানমারের মিয়ানমারের আট সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

ইয়াবা চোরাচালানে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধপথে পাচার হওয়ায় প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশি এক টাকার বিপরীতে মিয়ানমারের মুদ্রা বিনিময় হার নয় কিয়েতের নিচে নেমে এসেছে। দু'বছর আগেও এই মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবধান ছিল ১৫ টাকার বেশি। মিয়ানমার থেকে সীমান্তপথে প্রতিমাসে আসছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা।
এসব তো শুধু অর্থের হিসেব, ইয়াবার ফলে তৈরি হচ্ছে যে কত শত ঐশী, সারিকা- এর হিসেব কি আমরা রাখব না? যেখানে রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়েও প্রবল এই ইয়াবা মহামারী!

তথ্যসূত্র : অগুনিত পত্রিকা,ব্লগ এবং ডক্টর অরূপ রতনের বিভিন্ন কলাম লেখা

No comments

Powered by Blogger.